
কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানের কথা মনে পড়ে। ২০২০ সালে রিগ্যানকে ডিসি সুলতানা পারভীন মোবাইল কোর্ট পাঠিয়ে ধরে এনেছিলেন, রাতে বাসা থেকে। সঙ্গে কয়েক গ্রাম গাঁজা আর আর আধা বোতল মদ। ডিসি অফিসের মোবাইল কোর্ট আরিফুলকে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে এক বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল।
আরিফুলের অপরাধ ছিল সে ‘সুলতানা সরোবর’ কাহিনী প্রকাশ করেছিল। কাবিখার টাকায় পুকুর সংস্কার করে তার নাম রেখেছিলেন নিজের নামে ‘সুলতানা সরোবর’। সরোবরের পাশে সুলতানার সেই ছবি তখন ভাইরালও হয়েছিল।
তখন স্থানীয় কিছু সাংবাদিক সুলতানার পক্ষ নিয়ে আরিফুলকে মাদক ব্যবসায়ী বানাবার পাঁয়তারা করেছিলেন। সেভাবে তারা ঢাকায় প্রতিবেদনও পাঠিয়েছিলেন। দুই-একটি অনলাইনে তখন প্রকাশও হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরোবরের অতলে সেই ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায়। বেরিয়ে আসে ডিসি সুলতানা ও তার সহযোগীদের প্রতিহিংসার কথা।
তখন দেখেছি, আরিফুল আটক হওয়ার পর তাকে উদ্ধার বা তাকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে কতিপয় সাংবাদিক সুলতানার পদলেহনে ব্যস্ত ছিল। তারা কোনো প্রতিবাদও করেননি কুড়িগ্রামে। দেশের একটি শীর্ষ দৈনিকের কুড়িগ্রামের সাংবাদিক, যিনি আবার সাংবাদিক নেতা, তিনি ডিসির পক্ষ নিয়ে প্রতিবেদন পাঠানোর পর তার অফিস খোঁজ নিয়ে তার দালালি ধরতে পারে। তখন তারা ঢাকা থেকে এক প্রতিবেদককে দায়িত্ব দিলে তিনি সঠিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সেই সাংবাদিককে চাকরি থেকে বিদায় করেছে তার অফিস। দেশব্যাপী সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের কারণে ডিসি সুলতানাও সেখানে থাকতে পারেননি।
এবার আরেক গল্প- সাতক্ষীরার সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁকে নিয়ে। তাকে পুলিশ গত ২৩ জানুয়ারি আটক করে। তার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে বিস্ফোরক ও নাশকতার মামলা। সঙ্গে চাঁদাবাজির মামলাও একটা। তাকে আটকের পর ইলেকট্রিক শক দেয়ার অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী। তিনি ছয়দিন পর রোববার আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
এই রঘুনাথকে আটক করা হয় সকাল ১১টার আগে সাতক্ষীরা শহরের দিবা-নৈশ কলেজের সামনের মোড় থেকে। প্রথমে তাকে আটক বা গ্রেফতারের কথা অস্বীকার করে পুলিশ। পরে রাত ১০টার দিকে তাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে বিস্ফোরক ও নাশকতা এবং চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেফতারের কথা জানানো হয়। বিকেল ৫টার দিকে মামলা দেখানো হয়। বলা হয়, তাকে সাতক্ষীরা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে আরেকটি উপজেলার দেবহাটা থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, দেবহাটা থানার সাপমারা খাল ব্রিজ এলাকায় নাশকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ওইদিন সকালে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটালে পুলিশ রঘুনাথ খাঁসহ তার অপর তিন সহযোগীকে আটক করে। তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে বিস্ফোরক ও নাশকতার মামলা করেছে। আর স্থানীয় একজন চাঁদাবাজির মামলা করেন।
আর পুলিশ সুপার আমাকে বলেছেন, ‘রঘুনাথ ২০-৩০ জন সন্ত্রাসী নিয়ে বোমা ফাটাতে ফাটাতে ওই এলাকায় ঘের দখল করতে গিয়েছিল।’ তিনি আরও দাবি করেছেন, রঘুনাথ চাঁদাবাজ, সে অনেক মামলার আসামি। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, রঘুনাথ এতবড় চাঁদাবাজ হওয়ার পরও তার তেমন অর্থ-সম্পদ নেই কেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘ডাকাত কখনো ধনী হয় না’ পুলিশ সুপারের কথায় আমি সেদিন প্রচণ্ড প্রতিহিংসার প্রকাশ অনুভব করেছি। তিনি আমাকে বলেন, ‘তাকে অবশ্যই আমরা রিমান্ডে আনব। সে সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে।’ নিশ্চয়ই এর নেপথ্যে কারণ আছে। সাংবাদিক রঘুনাথ নাকি তার প্রতিবেদনে কাউকে ছাড় দিতেন না।
রঘুনাথের ব্যাপারে সাতক্ষীরা পুলিশ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে আটকের পরের ছবিসহ। তাতে তাকে চাঁদাবাজ ও বহু মামলার আসামি ও সন্ত্রাসী বলা হয়েছে। আর সাতক্ষীরার অনেক সাংবাদিক সেভাবেই প্রতিবেদন লিখেছেন। ঢাকার একটি পত্রিকার হেডিং হলো ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ রঘুনাথ গ্রেফতার’। ওখানকার প্রতিবেদকই প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। রঘুনাথ যে সাংবাদিক তাও উল্লেখ করা হয়নি।
তাকে গ্রেফতারের পর সাতক্ষীরায় সাংবাদিকদের কোনো প্রতিবাদ বা মুক্তি চেয়ে কোনো বিবৃতি আমার চোখে পড়েনি। আমি সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সভাপতির কাছে তাকে নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের জানা নাই, তার স্ত্রী আমাদের কিছু বলেননি।’ কিন্তু তারাই আবার রঘুনাথের স্ত্রীকে সংবাদ সম্মেলন করতে দেননি। সাতক্ষীরার মানবাধিকার কর্মীরাও তিন দিন পরও তদন্ত ছাড়া কিছু বলতে পারছিলেন না!
রঘুনাথের মুক্তির জন্য দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা সাতক্ষীরার সাংবাদিকরা না চালালেও তারা কিন্তু এসপি সাহেবকে মিষ্টি খাওয়াতে কোনো কার্পণ্য করেননি। রঘুনাথকে জেলে রেখে এসপি সাহেবের সঙ্গে চলে রীতিমত মিষ্টি উৎসব। তার আবার আয়োজন করেন একজন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান।
বৃহস্পতিবার রঘুরাথ তখনো জেলে। তার স্ত্রী আদালতে ঘুরছেন মামলার নথির জন্য। নথিও তাকে দেয়া হচ্ছিল না। আর ঠিক সেই সময়ে এসপির সঙ্গে তার অফিসে অনেক সাংবাদিক মিলিত হন, মিষ্টিমুখ করানো হয় তাদের। সেই ছবি ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে। তাতে দেখা যায়, একজন সম্মানিত সাংবাদিক এসপি সাহেবকে মুখে তুলে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। মিষ্টি খাওয়া ভালো। খাওয়ানো আরও ভালো।
খবর পেলাম এসপি সাহেব নাকি ওই মিষ্টি বৈঠকে আবার তেতো কথাও বলেছেন। তিনি নাকি বলেছেন, দেশ যেভাবে চলছে সাংবাদিকদেরও সেভাবে চলতে হবে, নয়তো রঘুনাথের পরিণতি হবে। এসপি সাহেবের কাছে প্রশ্ন সাতক্ষীরা কি পুরো দেশ নাকি?
টেকনাফের ওসি প্রদীপ ধরা খাওয়ার আগে সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফাকে আটকের পর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল। ফরিদুল মোস্তফার হ্যান্ডকাপসহ সংবাদ মাধ্যমে সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী বলে ছবি দিয়েছিল পুলিশ। তার বংশবদ সাংবাদিকরা কিন্তু সেভাবেই খবর লিখেছিলেন। ফরিদুল ওসি প্রদীপের মাদক বাণিজ্যের কথা প্রকাশ করে তার রোষানলে পড়েছিল। সে সেখানে প্রদীপ রাজত্ব কায়েক করতে চেয়েছিল। মেজর (অব.) সিনহাকে হত্যার পর তাকেও মাদক ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী বানিয়ে প্রেস রিলিজ দিয়েছিলেন কক্সবাজারের এসপি। সেটা পুলিশ করেই থাকে।
কিন্তু সাংবাদিকরা কী করবেন? তারা কি সেই প্রেস রিলিজ নির্ভর হবেন! তারা কি তাদের সহকর্মীদের চেনেন না? আর যদি মামলার আসামিও হয় তাহলেও তাকে কি নির্যাতন চালানো যায়। এক থানায় গ্রেফতার করে আরেক থানায় নিয়ে একই সময়ে কথিত ঘটনার মামলায় গ্রেফতার দেখানো যায়? আটকের পর ৭-৮ ঘণ্টা পর মামলা দিয়ে সন্ত্রাসী বললে তা কি একটুও খতিয়ে দেখবেন না সাংবাদিকরা? আর তিনি যদি তাদের সহকর্মী হন তাহলে তার জন্য কী কোনো দায়িত্ব নেই? সাতক্ষীরার সাংবাদিকদের কেউ কেউ যে কথা বলতে চাননি তা নয়। কেউ কেউ যে লিখতে চাননি তা নয়। তবে তাদের ভয় পাইয়ে দেয়া হয়েছে। একই পরিণতির কথা মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে। একজনকে ডেকে নাকি আগে নেয়া সুবিধার কথা মনে করিয়ে দিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
সুবিধা নিয়ে যেমন প্রতিবাদী হওয়া যায় না। তেমনি কিন্তু মিষ্টি খাইয়ে রক্ষাও পাওয়া যায় না। যদি এভাবে আমরা সুবিধা নিয়ে চুপচাপ থেকে মিষ্টি খাই তাহলে আমাদেরও কারাগারে যেতে হবে। তখন হয়তো বা অন্যরা মিষ্টি খাবে।
লেখক: হারুন অর রশিদ, সাংবাদিক
তথ্য: সময় টিভি ডট নিউজ